কুরআন ও হাদিসের আলোকে ঘুমের আদব
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ঘুম ও জাগরণও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামে ঘুমানো ও জাগ্রত হওয়ার সময় কিছু আদব ও নিয়ম পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নিয়মগুলো মানব জীবনের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। নিম্নে কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামে ঘুমের আদব ও জাগ্রত হওয়ার আদব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ঘুমের আদব
ঘুমানোর আগে ডান কাতে শোয়া
রাসূলুল্লাহ (সা.) ডান কাতে শুতে পছন্দ করতেন এবং এটিকে উত্তম বলে বিবেচনা করতেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
যখন তুমি ঘুমাতে যাবে, তখন অজু করো যেমন নামাজের জন্য অজু করো, তারপর ডান কাতে শোও।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩১১)
ডান কাতে শোয়ার মাধ্যমে হৃদয়ের উপর চাপ কমে এবং স্বাস্থ্যকর ঘুম নিশ্চিত হয়।
ঘুমানোর আগে দোয়া পড়া
ঘুমানোর আগে কিছু দোয়া ও আয়াত তিলাওয়াত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন:
সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার পড়া।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
যখন তুমি ঘুমাতে যাবে, তখন সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ো এবং তোমার দুহাতের উপর ফুঁক দিয়ে সমস্ত শরীরে মাসেহ করো।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০১৭)
ঘুমানোর আগের দোয়া:
আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহ্ইয়া।
অর্থ: “হে আল্লাহ, তোমার নামে আমি মৃত্যুবরণ করি এবং তোমার নামেই জীবিত হই।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩২৪)
বিছানা পরিষ্কার করা
ঘুমানোর আগে বিছানা পরিষ্কার করা এবং ঝেড়ে নেওয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
যখন তোমাদের কেউ বিছানায় যাবে, তখন সে যেন তার লুঙ্গি দিয়ে বিছানা ঝেড়ে নেয়, কারণ সে জানে না যে তার অনুপস্থিতিতে সেখানে কী আছে।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩২০)
অজু করে ঘুমানো
ঘুমানোর আগে অজু করা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
যখন তুমি ঘুমাতে যাবে, তখন নামাজের অজুর মতো অজু করো।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩১১)
ঘুমানোর সময় অশ্লীল চিন্তা থেকে দূরে থাকা
ঘুমানোর আগে পবিত্র চিন্তা ও আল্লাহর জিকির করা উচিত। অশ্লীল বা নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে থাকা ইসলামের শিক্ষা।
জাগ্রত হওয়ার আদব
জাগ্রত হওয়ার সময় দোয়া পড়া
জাগ্রত হওয়ার সময় নিম্নোক্ত দোয়া পড়া সুন্নত:
“আলহামদুলিল্লাহিল্লাযী আহ্ইয়ানা বা’দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর।
অর্থ: “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করেছেন এবং তাঁর কাছেই পুনরুত্থান।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩১২)
হাত পরীক্ষা করা
ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর হাত দিয়ে মুখমণ্ডল পরিষ্কার করা এবং হাত পরীক্ষা করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
যখন তোমাদের কেউ ঘুম থেকে জাগ্রত হয়, তখন সে যেন তার হাত দিয়ে মুখমণ্ডল পরিষ্কার করে, কারণ সে জানে না যে তার হাত রাতে কোথায় ছিল।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬২)
অজু করা
ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর অজু করা উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর অজু করো, কারণ ঘুমের সময় শয়তান তোমাদের কারো কানের পিছনে গিঁট লাগিয়ে দেয়।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩২৮)
ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া
ফজরের নামাজের জন্য সময়মতো জাগ্রত হওয়া এবং নামাজের প্রস্তুতি নেওয়া ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
নামাজ কায়েম করো, বিশেষত মধ্যবর্তী নামাজ এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে নত হয়ে দাঁড়াও।
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৩৮)
ঘুম ও জাগরণের সময়ের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
ইসলামে ঘুম ও জাগরণকে আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:
তিনিই তোমাদের রাতে ও দিনে নিদ্রা দেন এবং তিনি জানেন যা তোমরা দিনে অর্জন কর।
(সূরা আল-আনআম, আয়াত ৬০)
ঘুমকে মৃত্যুর সাদৃশ্য হিসেবে উল্লেখ করে কুরআনে বলা হয়েছে:
আল্লাহই মৃত্যু ঘটান রাতে এবং তিনি জানেন যা তোমরা দিনে কর। তারপর তিনি তোমাদেরকে জাগ্রত করেন দিনে, যাতে তোমাদের জন্য নির্ধারিত সময় পূর্ণ হয়।
(সূরা আল-আনআম, আয়াত ৬০)
ঘুম ও জাগরণের সময়ের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
ইসলামে ঘুম ও জাগরণের আদব শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। ডান কাতে শোয়া, অজু করা, দোয়া পড়া ইত্যাদি অভ্যাস মানসিক প্রশান্তি ও শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখে।
ইসলামে ঘুম ও জাগরণের আদব মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই আদবগুলো পালনের মাধ্যমে আমরা শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারি। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই আদবগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি।
রেফারেন্স:
1. সহীহ বুখারী
2. সহীহ মুসলিম
3. কুরআন মাজীদ (সূরা আল-বাকারা, সূরা আল-আনআম)
4. রিয়াদুস সালেহীন
সর্বশেষ সম্পাদনা: সোমবার, ১২ মে, ২০২৫ ০৭:২৯ পূর্বাহ্ন